ডেস্ক রিপোর্ট :
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শেষ করেছে প্রসিকিউশন। সোমবার শুনানিতে সালমান ও আনিসুলের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পড়ে শোনান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আন্দোলন দমনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্দেশে ২৮৬টি মিথ্যা মামলায় সাড়ে চার লাখ ছাত্র-জনতাকে আসামি করা হয়েছিল। আন্দোলন দমনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেন সালমান ও আনিসুল। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ফোনে কথা বলেন তারা। তাদের কথোপকথনের একপর্যায়ে শোনা যায়, ওদের (আন্দোলনকারীদের) শেষ করে দাও। অর্থাৎ আজ রাতেই কারফিউ জারির মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের শেষ করে দিতে হবে বলে জানান আনিসুল হক। শুনানির একপর্যায়ে তাদের একটি ফোনালাপ শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে। এরপরই সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ পড়েন চিফ প্রসিকিউটর। এ সময় প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন সালমান-আনিসুল। কিন্তু অনুমতি নিয়ে তাদের ফোনালাপটি ট্রাইব্যুনালে শোনাতেই একে অপরের দিকে তাকান তারা। একপর্যায়ে হাসি ফুটে উঠে দুজনের মুখে। একজন-আরেকজনের সঙ্গে কথাও বলেন। কথোপকথনে শোনা যায়, ফোনে সালমান এফ রহমানকে আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতাকে নির্মূল করে দেওয়ার কথা বলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই সঙ্গে কারফিউ জারির পরামর্শ দেওয়া হয়। যদিও একপর্যায়ে বলতে শোনা যায়, ‘এগুলো ফোনে বলা উচিত নয়।’
এরপর সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আলাদা আলাদা পড়ে এই দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর প্রার্থনা করেন চিফ প্রসিকিউটর। আসামিপক্ষে শুনানির জন্য ৪ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। প্যানেলের অন্য সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ।
সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ হচ্ছে-চব্বিশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেন সালমান ও আনিসুল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯ জুলাই ফোনে কথা বলেন তারা। তাদের কথোপকথনের একপর্যায়ে শোনা যায় ওদের শেষ করে দিতে বলেন। অর্থাৎ আজ রাতেই কারফিউ জারির মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের শেষ করে দিতে হবে বলে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
এরই ধারাবাহিকতায় ২২ জুলাই ব্যবসায়ীদের নিয়ে গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন সালমান এফ রহমান। ওই বৈঠকে জীবন দিয়ে হলেও হাসিনার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যেই আইনমন্ত্রীর নির্দেশে মিথ্যা মামলা করা হয়। যেখানে ৪ চার লাখ ছাত্র-জনতাকে আসামি করা হয়েছিল। তাদের এমন ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনায় প্রাণ দিয়েছেন বহু ছাত্র-জনতা। তবু নির্যাতন বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি তারা।
দ্বিতীয়ত, সালমান-আনিসুলের জ্ঞাতানুসারে ২৩ জুলাই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অর্থাৎ তাদের প্ররোচনা-উসকানিতে মিরপুরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় বাহিনী। তৃতীয়ত, মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্র করেছিলেন এ দুই প্রভাবশালী। তাদের উসকানি ও সহায়তায় ২৮ জুলাই মিরপুর-১০-এ আক্তারুজ্জামানকে জীবন দিতে হয়। আহত হন আরও অনেকে। চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, কারফিউ জারির মাধ্যমে মারণাস্ত্র ব্যবহারে উসকানি-প্ররোচনায় ৪ আগস্ট মিরপুর-১-এ আকাশ, সেতু, আলভীসহ ১২ জনকে হত্যা করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পাঁচ নম্বরে বলা হয়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে পরিকল্পনা করেন সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক। তাদের নির্দেশে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের হামলায় মিরপুর-২, ১০ ও ১৩ নম্বরে আল-আমিন, আশরাফুল, সাব্বির, রিতাসহ ১৬ জন হত্যার শিকার হন। ব্যাপক মাত্রা ও পদ্ধতিগত অপরাধ করেছেন সালমান ও আনিসুল। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই গঠনের জন্য আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। পরে আসামিপক্ষে শুনানির জন্য সময় চান সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী।
শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই আন্দোলন ঘিরে গঠিত গ্যাং অব ফোরের হয়ে ছাত্র-জনতাকে শেষ করে দেওয়ার সব ধরনের পরিকল্পনা করেছিলেন সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই আন্দোলন দমনে চারজনের বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতও ছিলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা বা নিঃশেষ-নির্মূল করার পরিকল্পনার জন্য এ চারজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে আন্দোলন দমনে কোথায়, কীভাবে অপারেশন হবে, কী অস্ত্র ব্যবহার হবে, কীভাবে হত্যা করা হবে, কাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে রাখা বা রিমান্ডে নেওয়া হবে-এসব কিছুর পরিকল্পনা করেছেন আনিসুল ও সালমান। জরুরি অবস্থা তথা কারফিউ জারির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শও দিয়েছিলেন তারা। জরুরি অবস্থা কার্যকরের ব্যবস্থা করেছেন এ দুজন।
তিনি বলেন, আমরা সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হকের একটি ফোনালাপের কিছু অংশ বাজিয়ে শুনিয়েছি ট্রাইব্যুনালে। ফোনালাপে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমন করার দুটি পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছিলেন তারা। একটা হলো কারফিউ দিয়ে আন্দোলনকারীদের একদম শেষ করে দেওয়া। দ্বিতীয়টি সামরিক শাসন জারি করে অভ্যুত্থান দমন করা। এই পরিকল্পনা তারা একইভাবে প্রধানমন্ত্রীকে দেন। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ দলের বৈঠকে কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সুতরাং আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে। অর্থাৎ তাদের পরামর্শ, নির্দেশনা, উসকানির মাধ্যমেই জুলাই-আগস্টে গণহত্যা হয়েছিল। তাদের এই সুপিরিয়র স্ট্যাটাস বা জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ-এ দুটির সমন্বয়ে সংঘটিত হয়েছিল হত্যাযজ্ঞ। সবমিলিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ গঠনের জন্য আবেদন করেছি ট্রাইব্যুনালে।
জুলাই আন্দোলনের সময় ফোনালাপ করেন আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান। ফোনালাপের একপর্যায়ে কারফিউ চলাকালে আন্দোলনকারীদের শেষ করে দিতে হবে বলে জানান তারা। তাদের এ বক্তব্যের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। সালমান-আনিসুলের এ বক্তব্যটি হত্যাকাণ্ডে উসকানি হিসাবে কাজ করেছে।
২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট পালাতে গিয়ে গ্রেফতার হন সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক। এরপর থেকে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন তারা।
চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা মামলায় যুক্তিতর্ক বুধবার : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আংশিক যুক্তিতর্ক শেষ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। পরবর্তী শুনানির জন্য বুধবার দিন নির্ধারণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলার গ্রেফতার চার আসামি হলেন-শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের সোমবার সকালে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ।
পলাতকরা হলেন-সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। চলতি বছরের ১৪ জুলাই আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।